বাংলাদেশ বার্তা ডেস্কঃ একজন ভাল শিক্ষক হওয়া খুব সহজ কাজ নয়। মৌলিক বিষয় গুলোতে দক্ষ হওয়ার পাশাপাশি ভিন্ন কিছু বৈশিষ্ট্য থাকা চাই, যা দেখে ছাত্রছাত্রীরা তাঁকে অনুসরণ করবে। একজন আদর্শ শিক্ষক তিনিই, যাঁর শিক্ষা ও স্মৃতি দীর্ঘকাল শিক্ষার্থীর মনে গেঁথে থাকে।
এদিক থেকে একজন শিক্ষক তাঁর ছাত্রদের কাছে সত্যিকারের অতিমানব, যাঁর থাকে সহজেই আকৃষ্ট করার ক্ষমতা। সেটা হতে পারে তাঁর জ্ঞানের গভীরতা, পঠনপদ্ধতি সুখময় করার দক্ষতা, সূক্ষ্মানুধাবন করার ক্ষমতা, আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গি, মার্জিত রুচিবোধ, পোশাক পরিচ্ছেদ, ক্যারিশমেটিক ব্যক্তিত্ব। শিক্ষক যখন তাঁর ছাত্রছাত্রীদের কাছে অনুসরনীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত হবে তখন তাদের শেখার ইচ্ছাটাও আরও বেড়ে যায়। এমন একজন শিক্ষকের জ্যান্ত উদাহরন হচ্ছেন, চুনতি হাকিমিয়া কামিল মাদ্রাসার ইতিহাস-ঐতিহ্যের গর্বিত ধারক-বাহক " মাওলানা এম, আজীজুল হক", যিনি আজীজ হুজুর নামে দীর্ঘ ৩০/৩৫ বছর পরও চুনতি মাদ্রাসার তখনকার ছাত্রদের হৃদয়ের মণিকোটায় দেদীপ্যমান হয়ে আছেন বিশেষভাবে।
ইলমে হাদিস, তাফসির, ফিকহ, আদব (আরবী সাহিত্য), নাহব (আরবি ব্যাকরণ), আকায়েদ, বালাগাত (আরবি ভাষালঙ্কার), মানতিক (যুক্তিবিদ্যা), ফালসাফা (দর্শন), ইসলামের ইতিহাস, বাংলা ও ইংরেজী সাহিত্যে সমান পাণ্ডিত্যের অধিকারী মাওলানা এম, আজীজুল হক। বিস্ময়কর প্রতিভাধর এই শিক্ষাগুরু আরবী, উর্দু, ফারসি, ইংরেজী ভাষায় অনর্গল পাঠদান ও বক্তৃতায় সমান পারদর্শী। ক্ষুরধার লেখনির একজন মেধাবী কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক ও ঔপন্যাসিক হিসেবে তিনি নব্বাই'র দশকের শুরুতে দেশব্যাপী বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। এসময় বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা ও সাময়িকীতে প্রকাশিত তাঁর গবেষণা ও বিশ্লেষণধর্মী লেখা সুধী মহলের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগায়। বাংলা একাডেমি'র আয়োজনে জাতীয় রচনা প্রতিযোগিতায় দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ শিক্ষার্থীদের পেছনে ফেলে তিনি সেরা প্রতিযোগী নির্বাচিত হয়েছিলেন। কাদিয়ানী ফেতনার স্বরূপ নিয়ে তাঁর সারগর্ভ লেখার বিরুদ্ধে কাদিয়ানীরা হাইকোর্টে মামলা পর্যন্ত করেছিল।
আমার পরম সৌভাগ্য, চুনতি হাকিমিয়া কামিল মাদ্রাসায় আজীজ হুজুরের ছাত্রাবস্থা থেকে শিক্ষকতা জীবনের প্রায় বার বৎসরের (আমাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক প্রফেসর ড. আ.ক.ম আবদুল কাদের সাহেবের ১৯৮৭ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৮৯ সালের মার্চ মাসের ৫ তারিখ পর্যন্ত প্রিন্সিপাল পদে দায়িত্ব পালনের পূর্বে এবং পরে ১৯৯২ ইং পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনসহ) সোনালী অধ্যয়ের দশ বৎসেরের সাক্ষী আমি। ১৯৭৯ সালে কামিল শ্রেণীতে ভর্তি হয়েই মাদ্রাসার সেরা মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচয় লাভ করেন তিনি। ১৯৮০ সালে কামিল পরীক্ষায় ১ম শ্রেণীতে ১ম স্থান অধিকার করে চুনতি হাকিমিয়া কামিল মাদ্রাসার সুনাম-খ্যাতি জাতীয় পর্যায়ে সমুন্নত করেন। ঐ বৎসর জাতীয় পর্যায়ে সেরা মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমন্ত্রণে হিজবুল বাহারে নৌবিহারে অংশগ্রহনের সুযোগ লাভ করেন। কামিলের রেজাল্টের পরপরই আশেকে রাসুল (সাঃ) হযরত শাহ হাফেজ আহমদ (রাহঃ) প্রকাশ শাহ সাহেব কেবলা ও মাদ্রাসার সিনিয়র উস্তাজদের ইচ্ছায় আজীজ হুজুর মুহাদ্দিস হিসেবে শিক্ষকতায় যোগ দেন। তিনি এমন একসময়ে শিক্ষকতায় যোগ দেন যখন চুনতি মাদ্রাসায় শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন জাতীয় পর্যায়ে একাধিকবার শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস হিসেবে নির্বাচিত আল্লামা আবদুল হাই নিজামী, শায়খুল হাদিস আল্লামা মোহাম্মদ আমিন (রাহঃ), আল্লামা আবদুর রশিদ (রাহঃ), আল্লামা কামাল উদ্দিন মুছা খতিবী (রাহঃ), ইলমে নাহাবের ইমামখ্যাত আল্লামা মোহাম্মদ কাসেম (রাহঃ) থেকে শুরু এমন সব বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ শিক্ষকমন্ডলী যাঁরা সমহিমায় ছিলেন মহিমান্বিত। একই পরিবেশে বেড়ে উঠেও আল্লামা আজীজুল হক হুজুরের মাঝে ব্যতিক্রমীধর্মী আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা-চেতনার বিকাশ ঘটে বিস্ময়কর ভাবে। চিরাচরিত কায়দায় অন্য দশজন যে জিনিসটিকে দেখতেন এবং ভাবতেন, সেই দেখা ও ভাবনায় তিনি তুলনাহীন মেধা ও সৃজনশীল মননের পরিচয় দিয়েছেন তাঁর কর্মমুখর জীবনের পরতে পরতে। একাধারে তিনি একজন বিদগ্ধ আলেম, মুহাদ্দিছ, মোফাচ্ছির, সাহিত্যিক, গবেষক, সুলেখক, সুবক্তা ও প্রতিষ্ঠান পরিচালক।
আজীজ হুজুর ক্লাস নিতেন কামিল থেকে দাখিল শ্রেণী পর্যন্ত। অত্যন্ত মেধাবী, বুদ্ধিদীপ্ত, ব্যক্তিত্ববান, বিচক্ষণ, চৌকস ও মার্জিত রুচিবোধ সম্পন্ন লাজুক স্বভাবের তারুণ্যউদ্দীপ্ত সুদর্শন শিক্ষক হিসেবে তাঁর অসাধারন বাচনভঙ্গি, আকর্ষণীয় উপস্থাপন কৌশল, সুনির্দিষ্ট বিষয়ে জ্ঞানের গভীরতা ছাত্রদের মনে গভীর রেখাপাত করতো। বিষয় উপস্থাপনা ও ব্যাখার ক্ষেত্রে তাঁর অনুসন্ধিৎসু ও বিশ্লেষণধর্মী মনের উপস্থিতি ছিল বিশেষ লক্ষ্যনীয়। অভিমানী ও জেদী স্বভাবের এই শিক্ষাবিদ চলনে যেমন, বাক-ব্যবহারেও তেমন। কৃত্রিমতার খোলস তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি কখনো। পদ- পদবীর প্রতি ছিল ভীষণ অনীহা। চুনতি হাকিমিয়া কামিল মাদ্রাসা ও কক্সবাজার হাশেমিয়া কামিল মাদ্রাসায় অনেক চেষ্টা করেও তাঁকে প্রিন্সিপাল পদে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। ক্লাসে তাঁর পাঠদানের দক্ষতা দেখে বিমোহিত-বিমুগ্ধ থাকতো ছাত্ররা। হুজুরের হস্তাক্ষর ছিল অসাধারন। কম্পিউটার প্রযুক্তির দুষ্প্রাপ্যতার ঐ সময়ে হুজুরের আরবী, বাংলা, উর্দু হস্তাক্ষরকে ছাপা অক্ষরের সাথে ফারাক করা মুশকিল ছিল। হুজুরের বাংলা ও জাদিদ আরবী হস্তাক্ষরের ঢং আর স্টাইল অনুকরণে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলতো ছাত্রদের মাঝে। ডিমাই, ডাবল ডিমাই সাইজে তৈরিকৃত অসাধারন ক্যালিগ্রাফিতে হুজুরের শৈল্পিক রুচিবোধের প্রকাশ পেতো। কবি ফররুখ আহমদের কবিতার কয়েকটি শ্লোক নিয়ে এই রকম দু'টি ক্যালিগ্রাফি হুজুর আমাকে উপহার দিয়েছিলেন, যা দীর্ঘদিন আমার পড়ার টেবিলের সামনে টাঙ্গিয়ে রেখেছিলাম। এককথায়, গতানুগতিকতার বিপরীতে সর্বক্ষেত্রে নিজস্ব স্টাইলের একটা ধারা তৈরি করতে সক্ষম হন তিনি। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি ছাত্রদের কাছে আইডলে পরিণত হন। ছাত্রদের মাঝে একপ্রকার প্রতিযোগিতা শুরু হয় হুজুরের লাইফ স্টাইল অনুসরণ-অনুকরণে। বিশেষ করে আমরা যারা হোস্টেলে থাকতাম তারা হুজুরের ব্যতিক্রমধর্মী সম্বোধনাত্মক শব্দাবলী নিয়ে খুব মজা করতাম। খুব মনে পড়ছে মাওলানা আবদুল হাই নদভী (পীর সাহেব- বায়তুশ শরফ), অধ্যাপক ড. আবুল আলা মো. হোছামুদ্দিন (চেয়ারম্যান, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ- ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ও আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশন), মাওলানা ছালাহুদ্দিন মোহাম্মদ বেলাল (বায়তুশ শরফের মরহুম পীর সাহেব শাহ মাওলানা কুতুব উদ্দিন (রাহঃ) এর একমাত্র সন্তান), সিলেটের ফারুক (লন্ডন প্রবাসী), মাওলানা মাহবুবুর রহমান (মরহুম মাওলানা ছাবের হেলালী রাহঃ'র ছোট ভাই)-সহ আমরা বেশ ক'জন বাল্যবন্ধুর সাথে হুজুরের অনেক মজার স্মৃতির কথা। বিশেষ করে হুজুরের বিয়ে উপলক্ষে কক্সবাজার খুরুলিয়া গ্রামের বাড়িতে বিয়ের আগেরদিন সারারাত এবং বিয়ের দিন শ্বশুরালয়ে নানা স্মৃতির কথা কখনো ভুলবার নয়।
জানতে পারলাম হুজুর নাকি খুব শীঘ্রই কক্সবাজার হাশেমিয়া মাদ্রাসা থেকে অবসরে যাবেন। হুজুর রাজি থাকলে বিশেষ কোন পদ সৃষ্টি করে প্রাতিষ্ঠানিক সম্মানীতে চুনতি হাকিমিয়া কামিল মাদ্রাসায় আনার উদ্যোগ নিলে মাদ্রাসার সুনাম আর সুখ্যাতি বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আশা রাখি, বিষয়টি বর্তমান মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটি, আঞ্জুমনে তোলবায়ে সাবেক্বীন (প্রাক্তন ছাত্র সমিতি) গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় এনে সুচিন্তিত সিদ্ধান্তে উপনীত হবে।
পরিশেষে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি চবি'র আরবী বিভাগের প্রফেসর ড.শাজাআত উল্লাহ ফারুকীকে সপ্তাহ দু'য়েক পূর্বে আজীজ হুজুরের অসাধারন ছবিটি পাঠানোর জন্য। ছবিটি পাবার পর ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা থেকে হুজুর সম্পর্কে মূলতঃ কিছু লেখার প্রয়াস।
সংগৃহীত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন