* দক্ষিণগাঁও শাহীবাগ বাজার এজেন্ট ব্যাংকিং কেন্দ্র শনিবারসহ ৬ দিন খোলা*

ইসলামী ব্যাংক দক্ষিণগাঁও শাহীবাগ বাজার এজেন্ট ব্যাংকিং কেন্দ্র * সকল প্রকার একাউন্ট খুলতে * * টাকা জমা করতে * টাকা উঠাতে * * বিদেশ থেকে পাঠানো রেমিটেন্স এর টাকা বোনাসসহ উঠাতে * দক্ষিণগাঁও শাহীবাগ বাজার এজেন্ট ব্যাংকিং কেন্দ্রে আসুন। * * দক্ষিণগাঁও শাহীবাগ বাজার এজেন্ট ব্যাংকিং কেন্দ্র শনিবারসহ ৬ দিন খোলা* * প্রয়োজনে যোগাযোগ করুনঃ 01711-458151* 01700-925241*

বুধবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২০

ঝড়ঃ নইম কাদের

বাংলাদেশ বার্তা ডেস্কঃ আজ ভয়াল ২৯এপ্রিল। ১৯৯১সালেল এদিনে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলকার রউপর দিয়ে বয়ে যায় ইতিহাসের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। এতে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। আমার বাড়ি ককসবাজারের বদরখালী হওয়ায় আমি খুব কাছে থেকে উপলব্ধি করেছি ধ্বংসের সেই তাণ্ডব।
৯১ এর ঘূর্ণিঝড় আমার মনে এতটা দাগ কেটেছে যে, আমি এখনো তা মন থেকে মুছে ফেলতে পারিনি।সেই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসকে আশ্রয় করে আমার লেখা গল্প ‘ঝড়’।
গল্পটি ২৫ এপ্রিল ২০১৪, দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত হয়েছিল।কয়েকজনের অনুরোধে পুনরায় পোস্ট করলাম।

আজ-কাল সবাই খুব ব্যস্ত। কারো কোন ফুরসৎ নেই। বন্ধু-বান্ধবের সাথে দেখা হলে সময়ের কথা উঠলেই সবার এক কথা ‘না, হাতে একদম সময় নেই।’ যান্ত্রিক সভ্যতা মানুষকে এভাবেই ব্যস্ত করে ফেলেছে। এত ব্যস্ততা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে আবার এমনও হয় যে, সময় কাটে না। যেমন আজ আমার হল। ছুটির দিন। দুপুরে খেয়ে বিছানায় কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করলাম। ঘুম দূরে থাক, তন্দ্রার সাক্ষাৎও মিলল না। অগত্যা বেরিয়ে পড়লাম ইরফানের উদ্দেশ্যে। অনেক দিন তার দেখা নেই। অবশ্য এ সময় তাকে পাবার সম্ভাবনা একেবারে নেই বললেই চলে। নাসিরাবাদ আবাসিক এলাকা, দশ নম্বর রোডে তাদের বাসা।
যা ভেবেছিলাম তাই হল। না, ইরফানকে পাওয়া গেল না। ইরফান ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়েছে দু’বছর হল। এখনো বেকার। বেকার হলে কি হবে, রাত বারটার আগে কিংবা সকাল সাতটার পরে তাকে কখনো বাসায় পাওয়া যায় না। আসলে বেকারদের কাজ সর্বদা একটু বেশি।
ফুটপাত ধরে হাঁটতে লাগলাম। আশ্বিনের রৌদ্রোজ্জ্বল বিকেলে হাঁটতে বেশ ভালই লাগছে। হাঁটতে হাঁটতে বিপ্লব উদ্যানে যখন পৌঁছি, ঘড়ির কাঁটা তখন সাড়ে পাঁচটার ঘর অতিক্রম করেছে। পার্কের দিকে তাকিয়ে মনে হল অনেক দিন শুধু নয়, অনেক মাস কোন পার্কে বসা হয়নি। ঢুকে পড়লাম ভেতরে। চার দিকে বার দু’এক চক্কর লাগালাম। একটি বেঞ্চও খালি নেই। সব জোড়ায় জোড়ায় টিনএজদের দখলে। ঘাসের উপর বসা আরো অনেকে। মাঝখানে ফোয়ারার পাশে দাঁড়িয়ে চারদিকে একবার চোখ বুলালাম। এ সময় এখানে একমাত্র আমিই বে-জোড়। নিজের তারুণ্যের উপর বড় বেশি আক্ষেপ হল। বাদামওয়ালাকে কয়েকবার ডাকতে হল। সেও বারবার যুগলদের কাছে যেতে চায়। কিছু বাদাম নিয়ে একপাশে বসে বসে চিবুলাম। তারপর একসময় আস্তে আস্তে পার্ক থেকে বেরিয়ে আসি।
শেখ ফরিদ মার্কেটের সামনে গিয়ে শহর এলাকার বাসের জন্য দাঁড়ালাম। এমন সময় রিক্সায় বসা এক ভদ্র মহিলার সাথে চোখাচোখি হল। লাল বাতি জ্বলায় রিক্সা দাঁড়িয়ে আছে।
পিয়ারু। পুরো নাম হাসনাতুননেছা, ডাকনাম পিয়ারু। তার সাথে আজ আমার প্রথম সাক্ষাৎ না হলেও এটা ছিল একেবারে অপ্রত্যাশিত। আমি চমকে উঠ্লাম। আশ্চর্য! সেও আমাকে চিনে ফেলেছে। তাড়াতাড়ি রিক্সা থেকে নেমে কাছে এসে বলল- আরে মাসুদ ভাই আপনি? অনেক দিন পর দেখা। কেমন আছেন?
আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু সে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল- সব কথা শুনব। তবে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নয়, বাসায় গিয়ে। এইতো সামনে রেল লাইন পেরিয়ে একটু গেলেই বাসা। চলুন। সে রিক্সাওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে বিদায় করে দিল। দু’জন হাঁটতে হাঁটতে চললাম।

পিয়ারুর সাথে আমার প্রথম দেখা বিয়ের আনন্দঘন পরিবেশে। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আকরামের বাড়ি ছিল কক্সবাজারের বদরখালী গ্রামে। ২৮ এপ্রিল ’৯১, তার বিয়ের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে বিয়েতে আমার অনেক দায়িত্ব ছিল। দু’দিন আগেই চলে গেলাম বদরখালী। চমৎকার গ্রাম। পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের শাখা মহেশখালী নদী, পূর্বে-দক্ষিণে চকরিয়া সুন্দর বন। মাঝখানে ব-আকৃতির সমতল গ্রামটি দেখে মনে পড়ে যায় ছোট বেলায় পড়া কবিতা- ‘আমাদের গ্রামখানি ছবির মতন’।
গ্রামের মানুষগুলো যেমন সরল, তেমনি উদার। শহর থেকে এসেছি শুনে যেদিকে যাই পাড়ার বুড়োরা পর্যন্ত জোর করে ঘরে নিয়ে যান। শহরে এমন হৃদ্যতাপূর্ণ আতিথিয়েতা অকল্পনীয়।
আটাশ তারিখ দুপুরে আকরামের বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের আসরেই মনে মনে ঈর্ষান্বিত হলাম আকরামের সৌভাগ্যের প্রতি। মা-বাবার পছন্দ করা বধূ হাসনাতুননেছা পিয়ারু চমৎকার মেয়ে। চকরিয়া কলেজ থেকে ডিগ্রি পরীক্ষা দিয়েছে, এখনো রেজাল্ট বেরোয়নি।

বিয়ের পরদিন চট্টগ্রাম চলে আসতে চেয়েছিলাম। বন্ধুরা সবাই চলে আসলেও আমি আকরামের অনুরোধ উপেক্ষা করে চলে আসতে পারিনি। এদিকে সকাল থেকে বার বার রেডিও-টেলিভিশনে আবহাওয়ার বিশেষ বুলেটিন প্রচার হচ্ছিল। ক্রমশ বাড়ছে বিপদ সংকেতের সংখ্যা। তারপর দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেত। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম।
সন্ধ্যায় সবাই আরমানদের পুরাতন আমলের মাটির তৈরি সৌখিন দ্বিতল ঘরে জড়ো হয়ে গল্প-গুজবে মশগুল হয়ে গেল। ছোট বড় সবার মাঝে বিয়ের আনন্দ। ছোটরা ছুটাছুটি হৈ-হুলোড় করছে আর বড়রা বেয়াই বাড়ির গল্পে মত্ত।
রেডিওতে আবহাওয়ার বিশেষ সংবাদ শুনে আমরা কয়েকজন মাত্র উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। কি আশ্চর্য! দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেত শুনেও লোকজনের মাঝে তেমন প্রতিক্রিয়াই লক্ষ্য করলাম না। শিশু-বুড়ো সবাই খোশ গল্পে বিভোর। বেশ জমে উঠেছে বিয়ে পরবর্তী আসর। বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। এদিকে ভয়ে ভেতরে ভেতরে আমার অবস্থা খুবই কাহিল।
এক সময় আকরাম আমাকে ঘরের ভেতরে তার রুমে ডেকে নেয়। এই প্রথম পিয়ারুকে সাধারণ বেশে দেখার সুযোগ হল। বই-এ পড়া ‘গ্রাম্য বধূর’ সবকিছুই পিয়ারুর মাঝে পরিলক্ষিত হল। আমাকে দেখে হাসতে হাসতে বলল- মাসুদ ভাই, এতক্ষণে বুঝি আমার খবর নেয়ার সুযোগ হল।
হাসিতে মুক্তা ঝরে শুনেছি। জীবনে আমি কখনো মুক্তা দেখিনি। ঝকঝকে দু’পাটি দাঁতের ক্ষিয়দাংশ প্রকাশ করা পিয়ারুর যে হাসি আজ আমি এই অজ পাড়া গাঁয়ে এসে দেখলাম, বাকী জীবন মুক্তা না দেখলেও আক্ষেপ থাকবে না। আমি পরিপার্শ্বিক সব ভুলে গিয়ে অসভ্যের মত হা করে চেয়ে রইলাম।
সে আবারো হাসতে হাসতে বলল- মাসুদ ভাই, এত কি ভাবছেন বলেনতো। আবহাওয়ার সংবাদ শুনে ভয় পেলেন নাকি?
পিয়ারুর কথায় তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম- দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেত চলছে। শহরের ছেলে আমি। শহরে বসে কালবৈশাখির ঝড় দেখেছি, কখনো প্লাবণ দেখিনি। সত্যি সত্যি যদি বিশ ফুট পানি হয়, কী যে অবস্থা হবে! বাসায় সবাই চিন্তায় থাকবেন।
আমার চিন্তাক্লিষ্ট মলিন চেহারা দেখে তার খুব মায়া হল। আমায় সান্ত্বনা দিয়ে বলল- ‘মাসুদ ভাই, অত ভাববেন না তো। দেখবেন কিছুই হবে না। আর কপালে যদি সত্যিই মৃত্যু লেখা থাকে, সবাই একসাথে মরবো কি বলেন?’ বলেই সে আবার হেসে উঠল। আকরামও তাতে যোগ দিয়ে হাসতে হাসতে বলল- বড় পিয়ার করে পিয়ারু নামক একটি মেয়েকে মাত্র গতকাল বিয়ে করলাম। আর আজ অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে হৃদয়ের পিয়ার মাথায় উঠবে। না, পানি যতই বাড়ুক আমি কিন্তু পিয়ারুকে মাথায় নিতে পারব না, বড়জোর কাঁধে নিতে পারি, মাসুদ তুই কি বলিস্?

আকরাম এমনভাবে রসিয়ে রসিয়ে কথাগুলো বলল যে, আমরা তিনজনই একসাথে হেসে উঠলাম।
শুরু হয়ে গেল ঝড়। মড় মড় শব্দে ভেংগে পড়তে লাগল গাছপালা। টিনের চাল উড়ে গেছে বাতাসের প্রথম ধাক্কায়। ঢেউ এর আঘাতে এক সময় ঝ্যাঁৎ করে ভেংগে পড়ল বারান্দার দেয়াল। আমাদের অপেক্ষা করতে বলে আকরাম বাইরে গিয়ে লোকজনদের এদিক সেদিক কিছু ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছে। দ্রুত বাড়তে থাকল পানি। উপায়ন্তর না দেখে আকরাম পানির স্রোতে ভেসে আসা গাছ, চাল ইত্যাদির উপর যাকে যেভাবে পারে জোর করে তুলে দিতে লাগল। বিয়ে উপলক্ষে আসা নারী আর শিশুদের সেকি বুক ফাটা কান্না! কিন্তু ঝড়ের তাণ্ডব আর পানির স্রোতের গর্জন তাদের সেই কান্নার রোল আল্লাহর আরশ পর্যন্ত পৌঁছতে দিয়েছে কি না বুঝতে পারলাম না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আকরাম ফিরে আসে। ততক্ষণে পানি ঘরের ভেতরে কোমর সমান হয়ে গেছে। যে কোন সময় ভেতরের দেয়াল ভেংগে পড়তে পারে। তাই আমরা বারান্দায় গিয়ে স্রোতের বিপরীতে দাঁড়ালাম। বারান্দায় আমরা মাত্র তিনজন- আমি, আকরাম এবং পিয়ারু। তিনজনই নির্বাক। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এই মুহূর্তে কী যে করব কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। হঠাৎ আকরাম দু’কদম এগিয়ে আমার কাঁধে হাত রেখে ধরা গলায় বলল-‘মাসুদ, শহর থেকে আসা বন্ধুরা সবাই সকালে চলে গেছে। পিয়ারুর বাড়ি থেকে যারা এসেছিল আবহাওয়া খারাপ দেখে বিকেলে তারাও চলে গেছে। শুধু তোকে যেতে দেই নি। নিজের উপর এখন আমার বড় আক্ষেপ হচ্ছে কেন তোকে যেতে না দিয়ে জোর করে রেখে দিলাম। তোর উপর আজ আমি এ কী অধিকার খাটালাম।
একটু থেমে আকরাম আবার বলতে লাগল- বন্ধু, ধ্বংসের যে তাণ্ডব শুরু হয়ে গেছে, জানি না আমাদের কার কী অবস্থা হয়... সে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ততক্ষণে বিশাল এক ঢেউয়ের আঘাতে বারান্দার দেয়াল ভেংগে যায় এবং আমরা বাইরে সিটকে পড়ি।
অন্ধকারে পানিতে হাবুডুবু খেতে খেতে অনুভব করলাম কেউ একজন আমাকে আঁকড়ে ধরে আছে। বুঝতে বাকী রইল না কে সে। পিয়ারু। আল্লাহর শুকরিয়া যে, ভাসতে ভাসতে আমরা বড় গাছের সাথে আটকে যাওয়া ঘরের ভাঙগা একটি চাল পেয়ে যাই। অতি কষ্টে পিয়ারুকে চালে তুলে এক হাতে পিয়ারুকে অন্য হাতে চাল ধরে সারারাত পানির ভেতরে কাটালাম। আমাদের উপর দিয়েই চলে গেল ধ্বংসের সেই ভয়াবহ তাণ্ডব।
শেষ রাতের দিকে ঝড়ের গতি কমে আসে। সেই সাথে আস্তে আস্তে কমতে থাকে পানি। আশ্চর্য! এতক্ষণ পর্যন্ত আমরা একটি কথাও বলিনি। ভোরের আলো ফুটে উঠলে নিজের অসংলগ্ন কাপড়-চোপড় যতটা সম্ভব সামলিয়ে পিয়ারু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে প্রশ্ন করল- আকরাম কোথায়?
আমি কোন জবাব না দিয়ে চাল থেকে তাকে নামিয়ে আকরামদের বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলাম। পানি কোথাও কোমর সমান, কোথাও বুক সমান। কোথাও আরো বেশি। বুঝতেও পারিনি যে, গত রাতে পানির স্রোতে আমরা প্রায় আধ মাইল দূরে ভেসে চলে গিয়েছিলাম। অনেক কষ্টে আকরামদের বাড়িতে এসে দেখি ভিটে-মাটির চিহ্ন পর্যন্ত নেই। কাউকে যদি বলা হয় গত সন্ধ্যায় এখানে মাটির একটি সৌখিন দ্বিতল বাড়ি ছিল, বাইরে বধূ-বরণ লেখা সুন্দর একটি গেইট ছিল। মাত্র দু দিন আগে এখানে বসেছিল বিয়ের এক জমজমাট আসর। কেউ এসব বিশ্বাস করবে না। ঘরের নীরব সাক্ষি হিসেবে ডাল-পালা বিহীন কয়েকটি ভাঙা গাছ এদিক সেদিক ছিটিয়ে ছড়িয়ে আছে মাত্র।
ভাংগা একটি গাছের গোড়ায় গিয়ে পিয়ারু বসল। কি করব কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। গত রাত থেকে কিছুই পেটে পড়েনি। তার সাথে শরীরের উপর দিয়ে বয়ে গেছে নানা ধকল। কিন্তু নির্বাক পিয়ারুর মুখের দিকে তাকিয়ে ক্ষুধা আর কষ্টের পরিবর্তে অন্য এক ভয় এসে ভর করল আমার উপর। হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টিকারী মুক্তো ঝরা সেই হাসি এখন পিয়ারুর মুখে নেই। বরং সেখানে ভর করছে অমাবস্যার সব অন্ধকার।
পানিতে ভাসছে শুধু লাশ আর লাশ। পরস্পর জড়াজড়ি করে ধরা একজোড়া লাশের দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় পিয়ারু বলল- গতরাতে আমি যার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, যাকে আকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলাম সে আকরাম, আপনি নন। এখন বুঝতে পেরেছি জীবনের শেষ অবলম্বন থেকেও আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। শহরের ছেলে আপনি, বন্ধুর বিয়ে উপলক্ষে গ্রামে এসেছেন। এক দিন আগেও আমার সব ছিল। কিন্তু আজ কিছু খেতে দেব দূরে থাক, কোথাও একটু বসতে দেব সে সুযোগও আমার নেই। মাত্র কয়েক ঘণ্টার তাণ্ডবে আমার সব শেষ হয়ে গেছে। আপনার অতি সত্বর বাসায় ফিরে যাওয়া দরকার। আপনি চলে যান। আনন্দ করতে এসে অনেক কষ্ট পেলেন। বিভৎস কিছু স্মৃতি নিয়ে যাচ্ছেন সাথে করে। আকরাম আপনাকে বড় বিশ্বাস করত। যদি পারেন আপনার বন্ধুকে ক্ষমা করে দেবেন।’

এমন সময় হাঁউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আকরামের বড় ভাই এসে হাজির। পানির স্রোতে তিনি নাকি অনেক দূর ভেসে চলে গিয়েছিলেন। তাঁর কান্না কিছুটা থামলে ইশারায় পিয়ারুর প্রতি লক্ষ্য রাখতে বললাম। আসলে এ সময়ে কেউ কারো প্রতি লক্ষ্য রাখার অবস্থায় নেই। গত রাতে এ ঘরে মেহমানসহ ত্রিশ-পঁয়ত্রিশজন লোক ছিল। অথচ এখন আমরা মাত্র তিন জন। জানি না চট্টগ্রামের কী অবস্থা। বাসায় সকলে নিশ্চয় আমার বেঁচে থাকার আশা ত্যাগ করেছেন। মা এর কথা মনে পড়তেই নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। বুক চিরে কান্না বেরিয়ে এল। তারপর চরম স্বার্থপরের মত পিয়ারুর কাছে গিয়ে বললাম- আপনি কিছু ভাববেন না, পানির স্রোতে আকরাম হয়ত একটু দূরে ভেসে গেছে, কিছুক্ষণের মধ্যে নিশ্চয় চলে আসবে- বলেই আমি চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে সামনে পা বাড়ালাম।
ক’ কদম গিয়ে পেছনে ফিরে দেখি পিয়ারু সেই একই ভাবে ভাংগা গাছের গোড়ায় গালে হাত দিয়ে বসে অছে এবং ভেসে যাওয়া অগণিত লাশের মাঝে কাকে যেন খুঁজে ফিরছে। ইচ্ছে করছিল আমি আবার ফিরে গিয়ে নিঃসঙ্গ পিয়ারুর পাশে দাঁড়াই, তাকে সান্ত্বনা দেই। কিন্তু পরক্ষণেই বাসার কথা মনে পড়ায় স্বার্থপর মন আমাকে আর পেছনে ফিরতে দেয়নি।

কোথাও রাস্তা-ঘাটের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। সব জমিনের সাথে মিশে গেছে। যতদূর চোখ যায় পানিতে ভাসছে লাশ আর লাশ। বদরখালী বাজারের কাছাকাছি এসে একত্রে ভাসমান পাঁচ ছয়টি লাশের একটিতে আমার চোখ আটকে যায়। পরণে এক খণ্ড কাপড় নেই। চোখ দুটো খোলা, ঠোঁট ইষৎ ফাঁকা। মনে হল আমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছে। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। দ্রুত এগিয়ে বন্ধুর হাত ধরে কাছে টেনে নিলাম। গত পরশু বিয়ে করেছে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আকরাম। হাতে লেগে আছে মেহেদী রং, ভাল করে চেয়ে দেখলাম, মনে হল বন্ধুর অধরে এখনো লেগে আছে নববধূর অধরে মাখা লিপস্টিক। গায়ের জামাটা খুলে বিবস্ত্র বন্ধুর কিছুটা লজ্জা ঢাকলাম। তারপর তাকে সামনে নিয়ে কিবলামুখি হয়ে দাঁড়ালাম জানাজার নামাজ পড়ার জন্য। শব্দ করে কাঁদলে নামাজ ভেংগে যায়। আজ আমি নামাজে দাঁড়িয়ে ছোট্ট শিশুর ন্যায় ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কেঁদেছি। জানি না কান্না বিজড়িত আমার এ প্রার্থনা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়েছে কি না। তারপর আস্তে করে বন্ধুকে তার সাথীদের দিকে ঠেলে দিয়ে বিড়বিড় করে বললাম- বন্ধু, পিয়ারুকে যেভাবে দেখে এসেছি, সে তোমার এ দৃশ্য সইতে পারবে না। এভাবে তার মুখোমুখি হয়ে তার কষ্ট বাড়ানোর আর কী দরকার। বরং চলে যাও দৃষ্টির আড়ালে, অনেক দূরে। পরকালে আবার দেখা হবে। পারলে ক্ষমা করে দিও।

যতই সামনে অগ্রসর হই, চোখের সামনে ভেসে উঠে গত সন্ধ্যায় দেখা পিয়ারুর হাস্যোজ্জ্বল মুখ আর কানে বাজে আকরামের কথা- বড় পিয়ার করে পিয়ারু নামক একটি মেয়েকে বিয়ে করেছি. . .। সকালে পিয়ারু বলা কথা- রাতে আমি যার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম সে আপনি নন, আকরাম।
চট্টগ্রাম এসে আমি দু এক দিনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বন্ধুসহ একটি রিলিপ টীম নিয়ে বদরখালী যাই। টীম সদস্যদের ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে বিস্তারিত খবরাখবর জানতে আকরামদের বাড়িতে পাঠিয়েছিলাম এবং আমার কথা বলতে নিষেধ করেছিলাম। আকরামদের ঘরে এগারজন সদস্যের মধ্যে মারা গেছেন চার জন। আকরাম, আকরামের বৃদ্ধা মা এবং দু জন শিশু। লজ্জায় আমি নিজে তাদের ঘরে যেতে পারিনি। কারণ আকরামের লাশ সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে শেষ বারের মত পিয়ারুকে দেখতে না দিয়ে যা করেছি, আমার ভেতর এক প্রকার অপরাধবোধ কাজ করেছে। আর সে দিন পিয়ারুকে ওভাবে ফেলে চলে এসে যে চরম স্বার্থপরের পরিচয় দিয়েছি, কিভাবে আমি তার মুখোমুখি হব?
এরপর আমি আর তাদের কোন খবর রাখিনি। আজ প্রায় দু বছর পর হঠাৎ পিয়ারুর সাথে দেখা সেই ককসবাজারের বদরখালী থেকে অনেক দূরে চট্টগ্রাম শহরে, যা ছিল একেবারে অপ্রত্যাশিত, অকল্পনীয়।

বাসায় গিয়ে পিয়ারুর কাহিনী শুনলাম। আকরামের মৃত্যুর পর পিয়ারুর মা-বাবা অনেক করে বলেছিলেন পিয়ারুকে চলে আসার জন্য। কিন্তু আকরামের বৃদ্ধ বাবাকে ফেলে সে চলে আসে নি। তা ছাড়া কিছুদিন পর সে বুঝতে পেরেছে, তার কোল আলোকিত করে নতুন মুখ আসবে। ছয় মাস আগে আকরামের বাবার মৃত্যু হলে পিয়ারু বাপের বাড়িতে চলে আসে। সাথে আকরামের ভালবাসার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন ফুটফুটে এক শিশু সন্তান। গ্রামের বাড়িতে নানাজনের নানা কথা, নানা প্রস্তাব। ওসব তার ভাল লাগেনা। তাই দুমাস হল সে চট্টগ্রামে তার বড় ভাইয়ের বাসায় চলে এসেছে। বর্তমানে সে একটি কিন্ডার গার্টেনে চাকরি করে। পিয়ারু তার বর্তমান নিয়ে বেশ ভাল আছে।
আমি বললাম- আপনি ভাল আছেন শুনে সত্যিই আমার খুব আনন্দ লাগছে। আমি দুঃখিত যে, এত দিন আপনাদের কোন খবরাখবর নিতে পারিনি।

সে ঈষৎ হেসে বলল- মাসুদ ভাই, কী যে বলেন। ইতিহাসের সেই ভয়াল রাত্রে নিজের জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে যদি আপনি আমাকে না বাঁচাতেন, আমি কি আজ আপনার সাথে কথা বলতে পারতাম? সেই ভয়াল রাতের কয়েক দিন পর আকরামের কয়েকজন বন্ধুসহ একটি রিলিপ টিম নিয়ে আপনি বদরখালী গিয়েছিলেন শুধু আমাদের জন্য। ওরা আমাদের ঘরে গিয়ে আমার কথা, পরিবারের অপরাপর সদস্যদের কথা একটা একটা করে জিজ্ঞেস করছিল এবং আকরামের কথা বলে কেঁদেছিল। তখনই আমি সব বুঝে ফেলেছিলাম। আপনি আমাদের ঘরে যাননি ইচ্ছে করে এবং সেটি এ জন্য যে, আপনাকে দেখলে আকরামের কথা মনে করে আমি কষ্ট পাব। তাছাড়া একজন মুসলমানের জন্য সর্বশেষ যে কাজটি করতে হয় আপনি ছাড়া আকরামের জন্য তাতো আর কেউ করেনি। ঝড়ের কিছু দিন পর আরমানের এক মামা এসে জানাল তিনি নাকি কার মুখ থেকে শুনেছেন যে, বিয়ে উপলক্ষে আসা আরমানের এক বন্ধু ভাসমান একটি লাশের আব্রু ঢেকেছে নিজের জামা খুলে দিয়ে। জানাজা পড়েছে একা দাঁড়িয়ে। তখন আমার বুঝতে মোটেও বেগ পেতে হয়নি যে, আকরামের সে বন্ধুটি আপনি ছাড়া আর কেউ নন এবং আপনি যার জানাজা পড়েছেন সে আকরাম ছাড়া আর কে হতে পারে?
তারপর এক মিনিট বসুন - বলে পিয়ারু ভেতরে চলে যায়।
কিছুক্ষণ পর ছোট্ট একটি বাচ্চা কোলে নিয়ে দোলাতে দোলাতে এসে বলল-সত্যিই আপনার বন্ধু বড় পিয়ার করে পিয়ারু নামক একটি মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন এবং এক দিনেই তিনি প্রাণ উজাড় করে আমাকে দিয়ে যান তাঁর ভালবাসার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। তাই আমিও আমার ছেলের নাম রেখেছি আকরাম। অবিকল আপনার বন্ধুর চেহারা পেয়েছে সে।
তারপর শিশুটির চোখে মুখে অজস্র চুমো দিয়ে হাসতে হাসতে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল- এই দেখুন আপনার বন্ধুর ছেলে। এক আকরামকে হারিয়ে আর এক আকরাম পেয়েছি আমি।
আম থ বনে চেয়ে রইলাম পিয়ারুর হাসিমাখা মুখের দিকে। এই সেই হাসি যা আমি দেখেছিলাম ২৯এপ্রিল ৯১ সন্ধ্যায়। তারপর আজ। দ্রুত আমার মাঝে অন্যরকম এক পরিবর্তন চলে আসে। হাত বাড়িয়ে বাচ্চাটিকে নিতে ভুলে গেলাম। কিছু ভেবে দেখার আগেই ঝট্ করে বলে ফেলি- আচ্ছা আপনার কি নতুন করে আর কারো ঘর সাজাতে ইচ্ছে হয় না?
পিয়ারুর মাঝে কোনরকম চাঞ্চল্য লক্ষ্য করলাম না। সে বাচ্চাটিকে বুকে চেপে ধরে সোফায় আমার সামনা সামনি বসে একবার আমার পুরো শরীরে চোখ বুলিয়ে নেয়। কিছুক্ষণের জন্য তার চোখ দুটি স্থির হয়ে থাকে আমার চোখে। জানিনা আমার চোখে কী দেখতে পেল সে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল- মাসুদ ভাই, আপনার বন্ধু আমাকে এক দিনে যা দিয়েছেন এবং তা এত বেশি যে, পুরো জীবন আমাকে তার ঋণ শোধ করে কাটাতে হবে। নানাদিক থেকে চাপ আসায় বিষয়টি নিয়ে অনেক ভেবেছি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। না, তা সম্ভব নয়। আমি পারব না। কিন্ডার গার্টেনে শিক্ষকতা করি। বড় আনন্দ পাই শিশুদের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে। মনে হয় আমিও শিশু।
মন থেকে আর সাড়া পাই না যে, আমি আবার যৌবনে পদার্পণ করি।
গল্পটি আমার প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‌’অন্তরে অন্তরা’ থেকে নেয়া।
নইম কাদের
E-mail : nayeemquaderctg@gmail.com
Mobile : 01819 398 338

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পবিত্র ঈদ-উল-আযহা’র শুভেচ্ছা.

  বাংলাদেশ বার্তা ডেস্কঃ  প্রতিবছর ঈদ আসে আমাদের জীবনে আনন্দ আর সীমাহীন প্রেম প্রীতি ও কল্যাণের বার্তা নিয়ে। তাই এ দিন সকল কালিমা আর কলুষতাক...