বাংলাদেশ বার্তা ডেস্কঃ বর্তমানে ৭৫টি দেশে ছয় শতাধিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ইসলামি ব্যাংকিং চালু রয়েছে। সারা বিশ্বে ইসলামি ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সম্পদের পরিমাণ প্রায় ২.১ ট্রিলিয়ন ডলার। ২০২০ সাল নাগাদ এই সম্পদ ৫ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিশ্বের বহু দেশেই এখন ইসলামের অর্থায়নপদ্ধতি গুরুত্বের সাথে আলোচিত ও পঠিত হয়। নামী-দামি বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইসলামি অর্থনীতি ও ব্যাংকিং পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এমনকি বিশ্বের ৫৫টি শীর্ষস্থানীয় আর্থিক ব্যবস্থা ও পুঁজিবাজারের (ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম) মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা অস্ট্রেলিয়ায় লা ট্রবি ইউনিভার্সিটিতে ইসলামি অর্থায়ন বিষয়ে মাস্টার্স প্রোগ্রাম চালু রয়েছে। এ ছাড়া ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন, ডারহাম, হার্ভার্ড ও স্ট্যানফোর্ডের মতো বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বের ৭৫টি দেশের নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইসলামি অর্থনীতি ও ব্যাংকিং বিষয়ে পাঠ দান করা হয়।
বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকব্যবস্থা তিন দশক অতিক্রম করেছে। আইডিবি ইসলামি ব্যাংকিংয়ের মডেল হিসেবে বাংলাদেশকে বিবেচনা করে। নাইজেরিয়া, উগান্ডা ও শ্রীলঙ্কাসহ বহু দেশের ইসলামি ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ অবদান রেখেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট বা বিআইবিএম আয়োজিত এক সেমিনারে উপস্থাপিত নিবন্ধে মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য ও উপসাগরীয় দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকগুলোতে শরিয়াহ পরিপালনের অবস্থা ভালো বলে উল্লেখ করা হয়।
বিশ্বব্যাপী ইসলামি ব্যাংকিংয়ের জনপ্রিয়তা ও ক্রমাগত উন্নতির পরও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতো এরও সমালোচনা করার মতো দিক রয়েছে। খ্যাতিমান গবেষকদের দৃষ্টিতে ঝুঁকি বিশ্লেষণ ও ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতা অর্জনে ইসলামি ব্যাংকিংকে যেতে হবে আরো বহু দূর, সৃষ্টি করতে হবে দক্ষ ও পেশাদার ব্যাংকার, ঘটাতে হবে পণ্যবৈচিত্র্য ও মানসম্মত সেবার উন্নয়ন। ইসলামি ব্যাংকিংয়ের সব স্তরে শরিয়াহর নীতিমালা ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন এখন এ শিল্পের বড় চ্যালেঞ্জ। শুধু মুনাফা দিয়ে তাড়িত হয়ে শরিয়াহ পরিপালনে শৈথিল্য দেখালে ইসলামি ব্যাংকিংয়ের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। ইসলামি ব্যাংকিংয়ের আরো চ্যালেঞ্জ আসছে বিশ্বব্যাপী আর্থিক উদারীকরণ, বিনিয়ন্ত্রণ ও বিশ্বায়ন থেকে। এগুলো মোকাবেলায় শক্তিশালী ভিত্তি, উচ্চতর দক্ষতা ও বিরূপ পরিবেশে টিকে থাকার শক্তি অর্জনে আগে থেকেই সচেষ্ট হতে হবে।
ইসলামি ব্যাংকব্যবস্থাকে আরো গতিশীল করতে একদল শরিয়াহ বিশেষজ্ঞ ও ইসলামি ব্যাংকারের প্রয়োজনীয়তা সময়ের অপরিহার্য দাবিতে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের অন্যতম শরিয়াহ স্কলার জাস্টিস তকি উসমানি বলেন, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামি আর্থিক লেনদেনসংক্রান্ত বিষয়গুলো অনেকটা উপেক্ষিত। এমন অনেক ইসলামি চিন্তাবিদ দেখতে পাওয়া যায়, যারা নামাজ-রোজা, বিবাহ-তালাকের ওপর গভীর জ্ঞান রাখলেও তারা আর্থিক লেনদেনের মাসয়ালা সম্পর্কে তেমন পারদর্শী নন। বিশেষ করে আধুনিক যুগের জটিল ব্যবসাবাণিজ্যসংক্রান্ত রীতিনীতি সম্পর্কে তারা খুব কম ধারণাই রাখেন। ফলে ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসার মূল সমস্যা বোঝাতে পারছেন না। আলেমরাও নিজ থেকে এসব বিষয় জানার চেষ্টা করেন না। ফিকহের যেসব মূলনীতির ওপর এসব সমস্যার সমাধান দেয়া যায় সেগুলো সম্পর্কে তারা ততটা অভিজ্ঞ নন বলে তারা ব্যবসাবাণিজ্যের বাস্তবসম্মত সমাধান দিতে ব্যর্থ হন। কাজেই ব্যবসায়ীরা মনে করেন আলেমদের কাছে প্রকৃত সমাধান নেই। তাই তারা যা খুশি করেন। অথচ পূর্ববর্তী আলেমরা এসব বিষয়ে খুবই সচেতন ছিলেন।
হানাফি মাজহাবের অন্যতম ফকিহ ইমাম মুহাম্মদ। তার নিয়ম ছিল বাজারে বাজারে গিয়ে ব্যবসায়ীদের সাথে ওঠাবসা করা এবং ব্যবসায়িক লেনদেন সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা নেয়া। এক দিন এক ব্যক্তি তাকে বাজারে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি আলেম মানুষ, কিতাব পড়া ও পড়ানো আপনার কাজ। আপনি বাজারে কেন? তিনি উত্তরে বললেন, আমি ব্যবসায়ীদের রীতিনীতি ও তাদের পরিভাষা সম্পর্কে জানতে এসেছি। কারণ এ ছাড়া সঠিক মাসয়ালা বের করা যায় না।
সম্প্রতি বিআইবিএম আয়োজিত ‘ইসলামি ব্যাংকগুলোতে করপোরেট সুশাসন’ শীর্ষক এক সেমিনারে বক্তারা প্রকৃত ইসলামি ব্যাংকিং নিশ্চিত করতে পরিচালকদের সদিচ্ছা, ইসলামি ব্যাংকিং নিয়ে আলাদা আইন, মান নির্ধারণকারী সংস্থা বা রেটিং এজেন্সি গড়ে তোলা এবং ইসলামি ব্যাংকিংয়ে শরিয়াহর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অনুসরণের তাগিদ দেন। কিন্তু তাদের বক্তব্য কোনো কোনো সংবাদপত্রে খণ্ডিতভাবে উপস্থাপিত হওয়ায় ইসলামি ব্যাংকিং সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে।
ইসলামি ব্যাংকিংয়ের সর্বাঙ্গীণ উন্নতিসাধনে প্রয়োজন বস্তুনিষ্ঠ ও গঠনমূলক সমালোচনা। কিন্তু সমালোচনার ক্ষেত্রেও রয়েছে নৈতিকতা ও জবাবদিহিতা। ইসলামের দৃষ্টিতে সমাধান জানা না থাকলে শুধু সমস্যা উসকিয়ে দেয়া সমালোচকের কাজ নয়, তাকে প্রকৃত সমস্যার সমাধানও বলে দিতে হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে মানুষ প্রতিনিয়ত নতুন সমস্যা ও পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে। এই নবোদ্ভাবিত সমস্যাদির শরিয়াহসম্মত সমাধান প্রয়োজন। সময়ের পরিবর্তনে উদ্ভাবিত নতুন, কঠিন ও জটিল সমস্যাকে যদি শরিয়াহর আলোকে বাস্তবানুগ সমাধান না দেয়া হয় কিংবা সমাধান না দিয়ে নীরবতা অবলম্বন করা হয়, তাহলে ইসলামি শরিয়াহ থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেবে। তাই সাম্প্রতিক উদ্ভাবিত বিষয়ের সমাধান অবশ্যই দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম র:-এর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, যদি কোনো সমাধানপ্রত্যাশীকে কোনো জরুরি বা প্রয়োজনীয় বিষয় থেকে বিরত থাকার মাসয়ালা দিতে হয়, তাহলে গবেষকের উচিত হবে তার বিকল্প পথ বলে দেয়া।
আমাদের দেশে ইসলামিক ব্যাংকিং নিয়ে অনেক সমালোচনা দেখা যায়। যাতে কোনো সারবস্তু খুঁজে পাওয়া যায় না। ইসলামি ব্যাংকিং সম্পর্কে ইতিবাচক ও গঠনমূলক আলোচনার পরিবর্তে সেখানে কুৎসা রটনাই মূল প্রতিপাদ্য হয়ে যায়। কিভাবে ইসলামি ব্যাংকিং করা যায়, কোথায় কোথায় ইসলামি ব্যাংকিংয়ে ত্রুটি আছে, কিভাবে তা সমাধান করা যায়, তা নিয়ে দিকনির্দেশনামূলক কিছু তাদের আলোচনায় থাকে না। কোনো কোনো সমালোচক এমন আছে, যারা ইসলামি ব্যাংকার ও আর্থিক বিশ্লেষকদের আত্মসমালোচনা ও মূল্যায়নে বিবৃত ইসলামি ব্যাংকিংয়ের সীমাবদ্ধতাগুলোকে এ ব্যবস্থার দুর্বলতা হিসেবে তুলে ধরার অপচেষ্টা করে। এসব সমালোচকের দৃষ্টান্ত ওই ব্যক্তির মতো যে কোনো ধার্মিকের প্রার্থনায় উল্লিখিত কাকুতি-মিনতি ও অনুশোচনাকে তার অপরাধ হিসেবে তুলে ধরার কসরত করে। প্রচলিত ব্যাংকব্যবস্থার তুলনায় ইসলামি ব্যাংকিংয়ের বয়স একেবারেই কম। সামনে এগোতে হলে ডিঙাতে হবে বহু বাধা ও প্রতিকূলতার পাহাড়। আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এ ব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদি সফলতা ও সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজন কার্যকরী ও যোগ্য নেতৃত্ব, সব পক্ষের আন্তরিক সদিচ্ছা ও দায়িত্বশীল ভূমিকা এবং গঠনমূলক দিকনির্দেশনা।
ইমেজ সূত্র : https://www.google.com/
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন